শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১১

গত কিছুদিন হল ফেসবুক , মিডিয়ায় একটি বিষয় বেশ আলোচিত হচ্ছে । ইস্যুটা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা 'প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট ' ওরফে পিএসসি - ২০০৮ এর আলোকে কনকো ফিলিপসের সাথে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন সংক্রান্ত চুক্তি । বিষয়টাকে বিশেষজ্ঞদের আলোচনার বিষয় মনে করে অনেকেই হয়ত গা মাখাচ্ছেন না । তাই আমি গত দুইদিন হালকা পড়াশোনা করে যা বুঝলাম তাই নিজের ভাষায় আপনাদের বুঝানোর একটা ব্যর্থ প্রয়াস নিচ্ছি ।

শুরুতেই একটা উদাহরণ দিই ।

ধরুন আপনি বাজার থেকে মুরগী,গরু আর খাসীর মাংস কিনে নিয়ে আসলেন । রান্না করার তেল-মশলাও আপনার । রান্না শেষে আপনারই বাসার বুয়া গরু আর খাসীর মাংস তো পুরাটা নিয়ে গেলই । মুরগীর মাংসের তরকারী দিল আপনাকে মাত্র ২০ % । আর যদি রান্নার মশলা জোগাড় করতে না পারেন তাইলে ওই ২০% ও পাবেন না । যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরীর মত সবটুকু নিয়ে চলে যাবে । এবার আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন এমন কাজের বুয়া রাখবেন কিনা ?

উপরের উদাহরণের সাথে এবার বাস্তবের সামঞ্জস্য খোঁজার চেষ্টা করি আসুন ।

চুক্তিপত্রের সর্বপ্রথম সমস্যা যা বুঝলাম তা হল জ্বালানীর সংজ্ঞা ।



চুক্তিপত্রের ২ নং ধারার ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ,

এর তাৎপর্য হল চুক্তিপ্রাপ্ত কোম্পানী পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান ও উত্তোলন করবে ।

এখন পেট্রোলিয়ামের সংজ্ঞা দেওয়া এভাবে

দেখতে পাচ্ছি পেট্রোলিয়ামের সংজ্ঞায় তরল হাইড্রোকার্বনের উল্লেখ আছে । আর আমরা কমবেশী সবাই অবগত আছি খনিজ তেল , অ্যাসফাল্ট , বিটুমিন এরাও তরল হাইড্রোকার্বনের অন্তর্গত ।

সমস্যা দানা বাঁধছে তখনই যখন ১৫নং ধারার ৫অনুচ্ছেদের ৪ উপঅনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে

আর লক্ষ্য করলে দেখবেন শুধুই গ্যাসের কথা উল্লেখ আছে । যদি যথেষ্ট পরিমাণ তেল কিংবা অন্য খনিজ পাওয়া যায় তখন?? একটা বড় ফোঁকর তাই থেকেই যাচ্ছে । ব্যাপারটা অনেকটা গরু খাসী দুইটাই বুয়া নিয়ে চলে যাওয়ার মত নয় কি??



গ্যাসের ভাগ বাটোয়ারা কিভাবে হবেঃ

বঙ্গোপসাগরে বিশাল সম্পদ আছে সেটাকে ২৮ টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে তার মধ্যে দুটি ব্লক কনোকো ফিলিপসকে দেয়া হচ্ছে। যেটা বাংলাদেশের জন্য বিপদ সেটা হল, কস্ট রিকভারী এবং প্রফিট শেয়ারিং হওয়ার পরে বাংলাদেশ তার অংশ পাবে।

কস্ট রিকভারী হল তারা অনুসন্ধান ও উত্তোলনের খরচ উঠানোর জন্য মোট গ্যাসের ৫৫ শতাংশ রেখে দিবে । আর বাকী ৪৫ শতাংশ হল প্রফিট শেয়ারিং । এটা দুই পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হবে এবং এখানে দরকষাকষির একটা ব্যাপার আছে । সরকার যেহেতু এখনো চুক্তিটি জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না তাই ধরে নিলাম সর্বোচ্চ ২০ শতাংশই বাংলাদেশ পাচ্ছে । তবে কোনভাবেই বাংলাদেশ ২০% এর বেশি গ্যাস পাবে না। এবং সেই গ্যাসটা স্থলভাগে আনতে হলে বাংলাদেশের নিজের অবকাঠামো তৈরী করে আনতে হবে। এই অবকাঠামো বলতে পাইপ লাইন তৈরী করতে হবে গ্যাস আনার জন্য যা একটা বিশাল ব্যয়সাধ্য ব্যাপার।

আর ৮০% গ্যাস তারা পেট্রোবাংলাকে অফার করবে কেনার জন্য। পেট্রোবাংলা না কেনে তবে তারা দেশের মধ্যেই কোন তৃতীয় পক্ষকে ক্রয়ের প্রস্তাব দিবে । নইলে তারা সেটা এলএনজি(তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) করে বিদেশী রপ্তানী করবে এই বিধান রয়েছে পিএসসি ২০০৮ এ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যদি পেট্রোবাংলা পাইপলাইন তৈরী করতে না পারে?

উত্তরঃ সেক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা তার ২০ শতাংশ গ্যাস রেখে দেওয়ার ক্ষমতা হারাবে । এই কথাটার অর্থ হল স্থানীয় ব্যবহারের জন্য আমরা কোন গ্যাস পাবো না । আমাদের বাধ্যতামূলকভাবে কোম্পানীর পাইপলাইন দিয়ে গ্যাস রপ্তানী করে দিতে হবে । এর ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যখন আমরা একই সঙ্গে LNG(Liquified Natural Gas) আকারে রপ্তানি করবো কম দামে এবং অপেক্ষাকৃত বেশি দামে LNG গ্যাস আমদানি করবো বিদেশ থেকে।

চারপাশে শুধু সন্দেহের বেড়াজালঃ

সন্দেহ যখন আসে তখন তো চারদিক থেকেই আসে । আরও প্রশ্ন জাগতেই পারে কেন সম্প্রতি অনুমোদিত ২০০৯-১২ সালের জন্য প্রণীত রপ্তানি নীতিতে এই প্রথমবারের মতো রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা থেকে বিশেষ ভাবে এলএনজি গ্যাসকে বাদ রাখা হলো। রপ্তানি নীতি ২০০৯-১২’র পরিশিষ্টঐক এর ৮.১ (ক) ধারায় রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকার নীচেই লেখা হয়েছে:

‘‘সকল পেট্রোলিযাম এবং পেট্রোলিয়াম জাত উৎপাদন, তবে প্রাকৃতিক গ্যাস জাত দ্রব্য ছাড়া (যেমন, ফার্নেস অয়েল, লুব্রিকান্ট অয়েল, বিটুমিন, কনডেনসেট, এমটিটি, এমএস)।’’ তারপরেই আবার লেখা হয়েছে, ’’অবশ্য এই নিষেধাজ্ঞা উৎপাদন বণ্টন চুক্তির অধীনে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থাসমূহের অংশ পেট্রোলিয়াম বা এলএনজি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।’’

আমাদের নিজেদেরই কি এই কাজটা করার সক্ষমতা ছিল নাঃ

প্রফেসর ম তামিম আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রথম আলোতে যা লিখেছেন তা অনেকটাই গা বাঁচানো । তিনি বুঝাতে চেয়েছেন ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাপেক্স তেমন কোন অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে পারে নাই অথচ ২০০২ সাল পর্যন্ত আমাদের গ্যাসের ৯০-৯৫% গ্যাস আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতাম। সেটা এখন নেমে দাঁড়িয়েছে ৪৭%। এই ৪৭% গ্যাস সরকার রাষ্ট্রীয় গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তিনটির কাছ থেকে কেনে প্রতি হাজার কিউবিক ফুট ২৫ টাকায়। যেখানে উপরের হিসাব মোতাবেক বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে খরচ হয় ২৩৬ টাকা (আবু আহমেদের হিসাব মোতাবেক ২৫০ টাকা)। মজার ব্যাপার হচ্ছে- প্রতি হাজার কিউবিক ফিট এই ২৫ টাকায় বিক্রি করেও এবং তার বাইরেও সরকারকে রাজস্ব যুগিয়েও বিজিএফসিএল ও সিজিএফএল প্রতিবছর মুনাফা করে ।

এখন যদি বাপেক্সকে অকার্যকর করে রেখে বলা হয় তাদের অভিজ্ঞতা নাই ব্যাপারটা কি ইন্টার্নীর ডাক্তারের কাছে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়ার মতই হয়ে যাচ্ছে না???

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন